সূরা বাকারার শেষ তিন আয়াত

ইবনে আব্বাস (র) বলেন রাসুল (সা) যখন মদিনায়  আগমন করেন  সেই সময় মদিনার ইহুদিরা বলত ,এই দুনিয়ার বয়স সাত হাজার বছর । আর জাহান্নামে জাহান্নামিদেরকে শাস্তি প্রদান করা হবে দুনিয়ার এক হাজার  বছরের  মোকাবেলায়  আখেরাতের একদিন সমপরিমান। আর দুনিয়ার  সাত হাজার বছরের মোকাবেলায়  আখেরাতের সময় সাত হাজার বছর । সুতরাং

জাহান্নামিদের শাস্তি হবে দুনিয়ার হিসেবে  সাত হাজার বছর  অর্থাৎ আখেরাতের সাতদিন । এই অপব্যাখার প্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াতটি নাজিল হয়।                                                   দাহহাক (রহ) ইবনে আব্বাস (রা) হতে  বর্ণনা করেন ,কোন কোন  আলেম বলেন  ইহুদিরা দাবি করত, তাওরাতে উল্লেখ আছে  ,জাহান্নামের প্রশস্ত  হলো চল্লিশ বছরের পথ  সমপরিমান । আর ইহুদিরা জাহান্নামিরা প্রতিদিনে এক বছরের পথ অতিক্রম করবে  এবং চল্লিশদিনে জাহান্নামের সীমা শেষ হয়ে যাবে । আর তারা মাএ চল্লিশদিনের মাথায় জাহান্নাম থেকে মুক্ত হবে । এই দাবির প্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াতটি নাজিল হয়।

ইবনে  আব্বাস (রা) ও কাতাদা (রহ) হতে বর্ণিত হয়েছে  ইহুদিরা দাবি করত ,আল্লাহ তায়ালা আমাদের ব্যাপারে কসম করেছেন যে ,তিনি তাদেরকে বাছুর পুজার সমপরিমান চল্লিশ দিনের জন্য  জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন ,এরপর জাহান্নাম থেকে  বের করবেন । আল্লাহ তায়ালা তাদের দাবি মিথ্যা সাব্যস্ত করতে  এই আয়াতটি নাযিল করেন ।                                        ইবনে আব্বাস (র) হতে বর্নিত, তিনি  বলেন ,ইহুদিরা জাহেমিয়াদের মতো বিশ্বাস করতো যে ,তারা চিরস্থায়ি জাহান্নামি হবে না । এই দাবি প্রত্যাখান করে  আল্লাহ তায়ালা বলেন তোমরা যে চিরস্থায়ী জাহান্নামি হবে না , সে ব্যাপরে কি আল্লাহ তাআলার সাথে  প্রতিঙ্গাবদ্ধ হয়েছ ?  উল্লেখ্য বর্ণিত হয়েছে ,ইহুদিদের ধারণা অনুযায়ী তাদের উপর জাহান্নামের সময়কাল গত হওয়ার পর ফেরশতাগণ বলবেন ,হে আল্লাহর শএুরা !তোমাদের বর্ণিত মেয়াদ গত হয়েছে  কিন্ত চিরকাল অবস্থানের মেয়দকাল রয়েই গেছে ।

ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত হয়েছে ,ইহুদিরা বলত আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি দেয়া হবে  সেই সময়কাল পর্যন্ত যা তাওরাতে উল্লেখ আছে । আর তাহলো এক পাশ থেকে আরেক পাশ পর্যন্ত জাহান্নামের  দুরুত্ব হলো চল্লিশ বছরের পথ । আর জাহান্নামের শেষ প্রান্তরেই রয়েছে  জাক্কুম বৃক্ষ। ইহুদিদেরকে শাস্তি দিতে দিতে জাক্কুম বৃক্ষ পর্যন্ত আনা হবে । জাক্কুম বৃক্ষ পর্যন্ত যেহেতু জাহান্নামের প্রান্ত শেষ ,তাই এই পর্যন্ত আসার পর স্বয়ং জাহান্নামই নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং  ইহুদিরা তা থেকে মুক্তি পাবে । তাদের এই মিথ্যা ধারনা খন্ডন করতে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতটি নাযিল করেন।                                   মহান আল্লাহ পাক বলেন যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে  অঙ্গিকার নিলাম ,তোমরা পরস্পর খুনাখুনি করবে না এবং পরস্পরকে দেশ থেকে বহিস্কার করবে না ,তখন তোমরা তা স্বীকার করেছিলে এবং তোমরা তা স্বাক্ষ্য দিচ্ছীলে । অতঃপর তোমরা পরস্পর খুনাখুনি করছ  এবং তোমাদেরই  এক দলকে তাদের দেশ থেকে বহিস্কার করছ।তাদের ওপর পাপ ও অন্যায়ের মাধ্যমে অক্রমণ করছ । অথচ তাদের বহিস্কার করাই তোমাদের জন্য অবৈধ । তবে  কি তোমরা গ্রন্থের কিয়দাংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দাংশ অবিশ্বাস কর। যারা এরুপ করে পার্থিক জীবনে তাদের দূর্গতি ছাড়া আর কিছুই নেই । কেয়ামতের দিন তাদের কঠোরতম শাস্তিতে পৌছে দেয়া হবে । আল্লাহ তোমাদের কাজ -কর্ম সম্পর্কে বে-খবর নন।

ইবনে কাছির দিমাশকি(রহ) বলেন ,রাসুলুল্লাহ (স) এর যুগের  ইহুদিদের কর্মের নিন্দা ও তা প্রত্যাখান করে আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে ।বিষয়টি বুঝতে হলে একটি ভুমিকা বুঝতে হবে । তাহলো তাওরাতে ইহুদিদেরকে  কয়েকটি কাজের আদেশ করা হয়েছিল ।  যথা এক হত্যা ও খুনখারাবি না করা । দুই,কাউকে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত না করা । তিন নিজ গো েএর   কেউ শএুর হাতে বন্দি হলে তাকে মুক্ত করা ।

ইহুদীরা এই তিনটি বিধানের মধ্যে কেবল শেষাক্তো বিধানটি পালন করে প্রথম দুটি পরিত্যাগ করত ।ঘটনা হচ্ছে ,মদিনায় বসবাসকারী বিখ্যাত দুটি গোএ আওস ও খাজরাজের মধ্যে সুপ্রাচিনকাল থেকে  বংশীয়  শএুতা চলে আসছিল। জাহেলী যুগ থেকেই এই দুই গোএ ছিল মুর্তিপূজারী।এদিকে মদিনার ইহুদিরা ছিল তিন ভাগে বিভক্ত।বনু কায়নুকা ও বনু নজির ছিল খাজরাজের মিএ ।  অন্যদিকে বনু কুরায়যা ছিল  আওসের মিএ । ।বংশীয় সু েএ যখন আওস ও খাজরাজের মধ্যে পরস্পরে যুদ্ধ বেধে যেত তখন ইহুদিদের তিনটি দলও নিজ নিজ মিএদের পক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত হতো । এতে ইহুদিরাই একে  অপরকে  হত্যা করতে বাধ্য হত।                অথচ  তাদের ধর্মে নিজ নিজ লোকদের হত্যা করা কঠোরভাবে নিষেধ ছিল । তারা এই নিষেধাঙ্গা অমাণ্য করত বটে  কিন্ত  পরবর্তিতে যখন যুদ্ধ থেমে যেত এবং যুদ্ধ বন্দিদের মুক্ত করার প্রশ্ন আসত তখন  বিজয়ী গো েএ র  ইহুদিরা প্রতিপক্ষের পরাজিত  ইহুদিদের  যুক্ত করার জন্য অর্থ ব্যয় করত ।তাদেরকে এই ব্যপারে জিঙ্গাসা করা হলে বলত ,আমাদেরকে স্বজাতীয় বন্দিদেরকে মুক্ত করার আদেশ করা হয়েছে ,

এটা আমাদের জন্য ফরজ ।তখন যদি প্রশ্ন করা হতো ,তাহলে স্বজাতীয় বিরুদ্ধে লড়াই করা ও হাতিয়ার ধারণ করাও তো তোমাদের ধর্মে নিষেধ। সেটা মান্য করো না কেন ?জবাবে তারা বলতো মিএদের সহযোগিতা না করা  লজ্জাজনক ব্যাপার । তাদের এই দ্বিমুখি আচরণের  নিন্দা  এবং তাদের চরি  েএর বক্রতা প্রকাশের উদ্দেশ্য আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাযিল করেন ।

অতঃপর যখনই কোন রাসুল এমন নির্দেশ নিয়ে তোমাদের  কাছে এসেছে ,যা তোমাদের মনে ভালো লাগেনি ,তখনই তোমরা অহংকার করেছ ,অতঃপর তোমরা তাদের একদলকে মিথ্যাবাদি বলেছ এবং একদলকে হত্যা করেছে ।

আল্লামা বাগাবি (রহ) বলেন ,রাসুল (সা)  ইহুদিদের নিকট ঈসা (আ) এর ঘটনা  এবং তার নানা মুজিজার কথা উল্লেখ করলে তারা বলল ,আপনি যতক্ষন পর্যন্ত ঈসা (আ)  এবং তার মতো  অন্র নবী রাসুলগণের মতো মুজিযা হাজির না করবেন  ততক্ষণ পর্যন্ত  আমরা আপনার  আনুগত্য ও ইসলাম গ্রহণ করবো  না ।

তাদের এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে  এই আয়াতটি নাজিল হয়। অনুবাদ ঃতারা বলে আমাদের অন্তর আবৃত ,বরং কুফরের কারনে  আল্লাহ তাদের অভিসম্পাত করেছেণ ।ফলে তারা অল্পই ঈমান আনে  একবার ইহুদিরা বলল,আমাদের অন্তর ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ,তাই আমাদের জন্য মুহাম্মদ (সা) বা অন্য কারো ইলমের প্রয়োজনীয়তা নেই।তখন এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং ঘোষণা করা হয় ।    তাদের অন্তর ইলমের কারনে পরিপূূর্ণ নয়।                                  বরং তাদের হ্দয় সত্য গ্রহনের ব্যপারে আচ্ছাদিত । সেখানে হক ও সত্য প্রবেশ করে না ।

যখন তাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কিতাব এসে পৌছাল যা সে বিষয়ের সত্যায়ন করে যা তাদের কাছে রয়েছে ,অথচ এর আগে তারা কাফেরদের কাছে তা বর্ণনা করত ।  অবশেষে যখন তাদের কাছে পৌছাল যাকে তারা চিনে রেখেছিল ,তখন তারা অস্বিকার করে বসল।অতএব ,অস্বীকারকারীদের ওপর আল্লাহর  অভিসম্পাত ।                                            ইবনে আব্বাস(র)বলেন,খায়বারের ইহুদিরা বনু গাতফানের সাথে প্রায়ই যুদ্ধে লিপ্ত হতো।কিন্ত প্রতিবারই তাদের হাতে পরাজিত হতো । এই অবস্থায় তারা একটি নতুন কৈাশল অবলম্বন করে ।তারা এরপর থেকে যুদ্ধ লাগলেই নবীজির উসিলাই দুআ করতে শুরু করে।                       হে আল্লাহ নবীয়ে  উম্মি মুহাম্মদ যাকে  আপনি শেষ জমানায়  আমাদের জন্য নবীরুপে প্রেরণ করবেন,তার উসিলায় বনু গাতফানের বিরুদ্ধে আপনার নিকট  আমরা সাহায্য প্রার্থনা করি ।

এরপর থেকে ইহুদিরা যতবার গাতফানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছে  ততবার এ দুআ পাঠ করে বিজয় অর্জন করেছে । কিন্তু যখন রাসুল (সা)নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয় ,তখন তারা তাকে নবী হিসেবে অস্বীকার করে বসে।  এই প্রেক্ষাপটে আয়াতটি নাজিল হয়।           ইবনে আবু হাতেম (রহ) ইবনে অাব্বাস (রা) এর ক্রয় সূ েএ উল্লেক করেন ,ইহুদিরা নবীজির আগমনের পূর্বে আওস ও খাযরাজের বিরুদ্ধে তার নামের উসিলায় দুআ করত ।কিন্তু তাকে যখন  আরবে পাঠানো হলো  তখন এই ইহুদিরাই তাকে  অস্বীকার করে বসল ।এবং পূর্বের দাবি থেকে সরে আসল।

একদিন মুআজ বিন জাবাল (রা)বারা ইবনে আজেব (রা) এবং দাউদ বিন সালামা (রা)বললেন ,হে ইহুদী সম্প্রদায় !তোমরা আল্লাহকে ভয় করো  এবং ইসলাম গ্রহণ করো । কেননা তোমরাইতো আমাদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করার জন্য নবীজির নাম ধরে  দুআ করতে ।                       অথচ আমরা এই ব্যাপারে কিছুই জানতাম না । আমরা ছিলাম মূর্খ ও মুশরিক।তোমরা  আমাদেরকে জানালে যে ,মুহাম্মদ নবী হিসেবে  প্রেরীত হবেন এবং তোমরা তার গোটা হুলিয়া মোবারকও বিবরণ দান করতে ।অথচ আজ তোমরা নিজেরাই তাকে অস্বীকার করছ। এর জবাবে সালাম বিন মিশকাম নামক  এক ইহুদি বলল-

আমাদের জানা কোনো বিষয়ের অবতরণ ঘটেনি।  আর  আমরা তোমাদের নিকট যার কথা বলতাম ,ইনি তিনি নন ।

এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে  আয়াতটি নাযিল হয় । আল্লামা আলুসি (রহ) বলেন বনু নজির এবং বনু কুরাইযার  ইহুদীদের ব্যাপারে  আয়াতটি নাজিল হয়েছে । তিনি সুদ্দি (রহ) এর বরাতে উল্লেখ করেন ,যখন তাদের ও মুমরিকদের মধ্যে যুদ্ধ প্রচন্ড আকার ধারণ করত ,তখন তারা তাওরাত কিতাব বের করত  এবং তাওরাতের যে স্থানে রাসুল (সাঃ) এর আলোচনা  আছে  সেখানে হাত রেখে হাত রেখে বলত – হে আল্লাহ আপনি যাকে শেষ জমানায় নবী হিসেবে পাঠাবেন  সেই নবীর উসিলায় আপনার কাছে প্রার্থনা করছি ,আপনি আমাদেরকে আমাদের শএুর মোকাবেলায় বিজয়ী করুন ।

এভাবে দুআ করার পর তারা বিজয়ী হতো । কিন্ত যখন সেই প্রার্থিত নবি এলেন তখন তারা তাকে অস্বীকার করল।

এই প্রেক্ষাপটে এই আয়াতটি নাযিল হয়।

Leave a Comment