ইউসুফ (আঃ) এর প্রতি হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর অসাধারণ মহব্বত ছিল । ইউসুফ (আঃ) নিখোঁজ হয়ে গেলে তিনি একেবারেই হতোদ্যম হয়ে পড়েন । কোন কোন রেওয়াতে পিতা ছেলের বিচ্ছেদের সময়কাল চল্লিশ বছর এবং কোন কোন রেওয়াতে আশি বছর বলা হয়েছে । দীর্ঘ সময়ে তিনি ছেলের শোকে কাঁদতে কাঁদতে অতিবাহিত করেন। ফলে তার দৃষ্টিশক্তি রহিত হয়ে যায় । সন্তানের মহব্বতে এতটা বাড়াবাড়ি বাহ্যতঃ পয়গম্বরসুলভ পদমর্যাদার পক্ষে শোভনীয় নয় ।অর্থাৎ তোমাদের ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততি ফেৎনা ও পরিক্ষা বৈ নয়। পক্ষান্তরে কোরআন পাকের ভাষায় পয়গম্বরগণের শান হচ্ছে এই অর্থাৎ আমি পয়গম্বরগণকে একটি বিশেষ গুনে গুণান্বিত করেছি। সে গুণ হচ্ছে পরকালের স্মরণ । মালেক ইবনে দীনারের মতে এর অর্থ এই যে ,আমি তাদের অন্তর থেকে সাংসারিক মহব্বত বের করে দিয়েছি এবং আখেরাতের মহব্বত দ্বারা তাদের অন্তর পরিপূর্ণ করে দিয়েছি এবং শুধু আখেরাতের মহব্বত দ্বারা তাদের অন্তর পরিপূর্ণ করে দিয়েছি। কোন বস্তু গ্রহণ ও প্রত্যাখানের ব্যাপারে তাদের একমাএ লক্ষ্য হচ্ছে আখেরাত ।
এ বর্ণনা থেকে এ সন্দেহ আরো কঠিনভাবে প্রতিয়মান হয় যে ইয়াকুব (আঃ) এর সন্তানের মহব্বতে এতটুকু ব্যাকুল হয়ে পড়া কেমন করে শুদ্ধ হতে পারে । কাযী সানাউল্লাহ পানিপন্থি(রহ) তফসীরে মাযহারিতে এ প্রশ্ন উল্লেখ করে হযরত মুজাদ্দিদে -আলফেসানীর এক বিশেষ বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন । এর সারমর্ম এই যে নিঃসন্দেহে সংসার ও সংসারের উপকরণাদির প্রতি মহব্বত নিন্দনীয় । কোরআন ও হাদিসের অসংখ্য বর্ণনা এর পক্ষে স্বাক্ষ্য দেয় । কিন্তু সংসারের যেসব বস্তু আখেরাতের সাথে সম্পর্কযুক্ত,সেগুলোর মহব্বত প্রকৃতপক্ষে আখেরাতেরই মহব্বত । ইউসুফ (আঃ) এ র গুণ ও গরিমা শুধু দৈহিক রুপ সৈান্দর্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না । বরং পয়গম্বরসুলভ পবিএতা ও চারি িএক সৈান্দর্যও এর অর্ন্তভুক্ত ছিল । এ সমষ্টির কারণে তার মহব্বত ছিল। এখানে এ বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য যে , এ মহব্বত যদিও প্রকৃতপক্ষে সংসারের মহব্বত ছিল না ,কিন্তু সর্বাবস্থায় এতে একটি সাংসারিক দিকও ছিল। এ জন্যই এটা হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর পরিক্ষার কারণ হয়েছে এবং তাকে চল্লিশ বছরের সুদির্ঘ বিচ্ছেদের অসহনিয় যাতনা ভোগ করতে হয়েছে । এ ঘটনার আদ্যেপান্ত এ বিষয়ের সাক্ষ্য দেয় যে ,আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে দীর্ঘতর হয়ে গেছে। নতুবা ঘটনার শুরুতে এত গভির মহব্বত পোষণকারী পিতার পক্ষে পুএদের কথা শুনে নিশ্চুপ ঘরে বসে থাকা কিছুতেই সম্ভবপর হতো না।বরং তিনি অবশ্যই অকুস্থলে পৌছে খোঁজ খবর নিতেন ।ফলে তখনই যাতনার পরিসমাপ্তি ঘটতে পারত। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকেই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যে,তখন এদিকে দৃষ্টি যায়নি ।এরপর ইউসুফ (আ) কে পিতার সাথে যোগাযোগ করতে ওহির মাধ্যমে নিষেধ করা হলো ।
ফলে মিসরের শাসনক্ষমতা হাতে পেয়েও তিনি যোগাযোগের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি ।এর চাইতে বেশি ধৈর্য্যর বাঁধ ভেঙ্গে দেয়ার মতো ঘটনাবলি তখন ঘটেছে,যখন ইউসুফ ভ্রাতারা বার বার মিসর গমন করতে থাকে ।তিনি তখনও ভাইদের কাছে গোপন রহস্য খোলেননি এবং পিতাকে সংবাদ দেয়ার চেষ্টা করেননি ।বরং একটি কৌশলের মাধ্যমে অপর ভাইকেও নিজের কাছে আটকে রেখে পিতার মর্মবেদনাকে দ্বিগুণ করে দেন । এইসব কর্মকান্ড ইউসুফ এর মত একজন মনোনিত পয়গম্বর দ্বারা ততক্ষন সম্ভবপর নয় ,যতক্ষন না তাকে ওহির মাধ্যমে নির্দেশ দেয়া হয় । এ কারনেই কুরতবি প্রমুখ তফসিরবিদ ইউসুফ (আ) এর এসব কর্মকান্ডকে খোদায়ি ওহির ফলশ্রুতি সাব্যস্ত করেছেন । ছেলেরা পিতার এহেন মনোবেদনা সত্বেও এমন অভিযোগহিন সবর দেখে বলতে লাগল ঃ আল্লাহর কসম আপনি তো সর্বাবস্থায় ইউসুফকেই স্মরণ করতে থাকেন । ফলে হয় আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন ,না হয় মরেই যাবেন । প্রত্যেক আঘাত ও দুঃখের একটি সীমা আছে । সাধারণত সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে মানুষ দুঃখ বেদনা ভুলে যায় । কিন্তু আপনি এত দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও প্রথম দিনের মতই রয়েছেন এবং আপনার দুঃখ তেমনি সতেজ রয়েছে।
ইয়াকুব ( আঃ) ছেলেদের কথা শুনে বললেনঃ আমি আমার ফরিয়াদ ও দুঃখ কষ্টের বর্ণনা তোমাদের কাছে করি না ঃ বরং আল্লাহর কাছে করি । কাজেই আমাকে আমার অবস্থায় থাকতে দাও । সাথে সাথে একথাও প্রকাশ করলেন যে ,আমার স্মরণ করা বৃথা যাবে না । আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন কিছু জানি যা তোমরা জান না । অর্থাৎ আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে ,তিনি আমাকে সবার সাথে মিলিত করবেন । এ কাফেলার লোকজনকেও জিঙে্গস করতে পারেন যারা আমাদের সাথেই মিসর থেকে কিনান এসেছে। আমরা এ বিষয়ে সম্পুর্ন সত্যবাদি। এ ক্ষে েএ তফসীরে মাযহারিতে এ প্রশ্নটি পুর্ণব্যক্ত করা হয়েছে যে , ইউসুফ (আঃ) পিতার সাথে এমন নির্দয় ব্যবহার কেন করলেন ?নিজের অবস্থা তো পিতাকে জানালেনই না ,তদুপরি ছোট ভাইকেও রেখে দিলেন । ভ্রাতারা বারবার মিসরে এসেছে ,কিন্তু তাদের কাছে আত্মপরিচয় প্রকাশ করলেন না এবং পিতার কাছে সংবাদ পাঠালেন না । এসব প্রশ্নের উওর তাফসীরে মাযহারিতে বলা হয়েছে ঃ ইউসুফ (আ) এসব কাজ আল্লাহর নির্দেশই করেছিলেন , ইয়াকুব (আ) এর পরিক্ষাকে পূর্ণতা দান করাই ছিল এ সবের উদ্দেশ্য। ্এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে মানুষ যখন কারো সাথে কোন চুক্তির আবদ্ধ হয় ,তখন তা বাহ্যিক অবস্থার ক্ষে েএই প্রযোজ্য হয় ,অজানা বিষয়বস্তুর ক্ষে েেএ প্রযোজ্য হয় না । ইউসুফ -ভ্রাতারা পিতার সাথে বেনিয়ামিনের হেফাযত সম্পর্কে যে অস্বিকার করেছিল ,তা ছিল তাদের আয়ওাধিন বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত। বেনিয়ামেনের চুরির অভিযোগ গ্রেফতার হওয়াতে অস্বীকার কোন এুটি দেখা দেয়নি । তফসিরে কুরতুবিতে এ আয়াত থেকে আরও একটি মাসআলা বের করে বলা হয়েছেঃ এ বাক্য দ্বারা প্রমাণিত হয় যে,স্বাক্ষ্যদান জানার উপর নির্ভরশিল।ঘটনা সম্পর্কে নলেজ যেভাবে হোক ,তদনুযায়ি সাক্ষ্য দেয়া যায় । তাই কোন ঘটনার সাক্ষ্য যেমন চাক্ষুষ দেখে দেয়া যায় ।তবে আসল সুএ গোপন করা যাবে না -বর্ণনা করতে হবে যে ঘটনাটি সে নিজে দেখেনি -অমুখ নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির কাছে শুনেছে । এ নীতির ভিওিতেই মালেকি মাযহারের ফিকহবিদগণ অন্ধ ব্যক্তির স্বাক্ষ্যকেও বৈধ সাব্যস্ত করেছেন । আলোচ্য আয়াতসমুহ থেকে আরও প্রমাণিত হয় যে ,কোন ব্যক্তি যদি সৎ ও সঠিক পথে থাকে:কিন্তু ক্ষেএ এমন যে ,অন্যরা তাকে অসৎ কিংবা পাপকাজে লিপ্ত বলে সন্দেহ করতে পারে তবে তার পক্ষে এ সন্দেহর কারণ দুর করা উচিত ,যাতে অন্যরা কু ধারণার গোনাহে লিপ্ত না হয় । ইউসুফ (আ) এর সাথে কৃত পূর্ববর্তি আচরণের আলোকে বেনিয়ামিনের ঘটনায় ভাইদের সম্পর্কে এরুপ সন্দেহ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক ছিল যে ,এবার ও তারা মিথ্যা ও সত্যের আশ্রয় গ্রহন করেছ । তাই এ সন্দেহ দুরিকরণের জন্য জনপদ অর্থাৎ মিসরবাসিদের এবং যুগপৎ কাফেলার লোকজনের সাক্ষ্য উপস্থিত করা হয়েছে । রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ব্যক্তিগত আচরণের মাধ্যমেও এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন । একবার তিনি উম্মুল মুমিনিন হযরত সাফিয়্যাহ (রাঃ) কে সাথে নিয়ে মসজিদ থেকে এক গলি দিয়ে যাচ্ছিলেন ।গলির মাথায় দুজন লোককে দেখে তিনি দুর থেকেই বলে দিলেন ঃআমার সাথে সাফিয়্যা বিনতে হুযাই রয়েছে । ব্যক্তিদ্বয় আরয করলঃ ইয়া রসুলুল্লাহ আপনার সম্পর্কেও কেউ কু-ধারণা করতে পারে কি ? তিনি বললেন হাঁ শয়তান মানুষের শিরা উপশিরাই প্রভাব বিস্তার করে । কাজেই কারও মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে দেয়া বিচিএ নয়।-(বুখারি ,মুসলিম,কুরতুবি)
ইয়াকুব (আঃ)-এর ছোট ছেলে বেনিয়ামিন মিসরে গ্রেফতার হওয়ার পর তার ভ্রাতারা দেশে ফিরে এল এবং ইয়াকুব (আঃ) যাবতিয় বৃওান্ত শুনাল ।তারা তাকে আশ্বস্ত করতে চাইল যে ,এ ব্যপারে তারা সম্পুর্ণ সত্যবাদি । বিশ্বাস না হলে মিসরবাসিদের কাছে কিংবা মিসর থেকে কেনানে আগত কাফেলার লোকজনের কাছে জিগ্যেস করা হয় ।তারাও বলবে যে ,বেনিয়ামিন চুরির কারণে গ্রেফতার হয়েছে । ইউসুফ (আঃ) এর ব্যাাপারে ছেলেদের মিথ্যা একবার প্রমানিত হয়েছিল । তাই এবারও ইয়াকুব (আঃ) বিশ্বাস করতে পারলেন না ; যদিও বাস্তবে তারা এ ব্যাপারে তারা বিন্দুমাএ মিথ্যা বলেনি। এ কারণে এ ক্ষে েএও তিনি ঐ বাক্যই উচ্চারণ করলেন ,যা ইউসুফ (আঃ) এর নিখোজ হওয়ার সময় উচ্চারণ করেছিলেন ।অর্থাৎ তোমরা যা বলছ ,সত্য নয় ।তোমরা মনগড়া কথা বলছ,কিন্তু আমি এবারও সবর করব । সবরই আমার জন্য উওম। এ থেকেই কুরতুবি বলেনঃমুজতাহিদ ইজতিহাদের মাধ্যমে যে কথা বলেন তা ভ্রান্তও হতে পারে ।এমনকি,পয়গম্বরও যদি ইজতিহাদ করে কোন কথা বলেন, তবে প্রথম পর্যায়ে তা সঠিক না হওয়াও সম্ভবপর। যেমন ,এ ব্যপারে হয়েছে। ইয়াকুব (আঃ) ছেলেদের সত্যকেও মিথ্যা মনে করে নিয়েছেন ।কিন্তু পয়গম্বরগণের বৈশিষ্ট্য এই যে ,আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে ভ্রান্তি থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। কাজেই পরিণামে তারা সত্যে উপনিত হন।
এমনও হতে পারে যে মনগড়া কথা বলে ইয়াকুব(আঃ) ঐ কথা বুঝিয়েছেন যা মিসরে গড়া হয়েছিল । অর্থাৎ একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের নিমিও কৃওিম চুরি দেখিয়ে বেনিয়ামিনকে গ্রেফতার করে নেয়া।অবশ্য ভবিষ্যতে এর পরিণাম চমৎকার আকারে প্রকাশ পেত। আশা করা যায় যে .সম্ভবত ঃশীঘ্রই আল্লাহ তাদের সবাইকে আমার কাছে পৌছে দেবেন । মোটকথা ,ইয়াকুব (আঃ) এবার ছেলেদের কথা মেনে নেননি। এই না মানার তাৎপর্য ছিল এই যে ,প্রকৃতপক্ষে কোন চুরিও হয়নি এবং বেনিয়ামিনও গ্রেফতার হয়নি। এটা যথাস্থানে নির্ভুল ছিল। কিন্তু ছেলেরা নিজ ঙ্গানমতে যা বলেছিল,তাও ভ্রান্ত ছিল না। দ্বীতিয়বার আঘাত পাওয়ার পর ইয়াকুব (আঃ) এ ব্যপারে ছেলেদের সাথে বাক্যলাপ ত্যাগ করে পালনকর্তার কাছেই ফরিয়াদ করতে লাগলেন এবং বললেন ঃইউসুফের জন্যে বড়ই পরিতাপ । এ ব্যথাই ক্রন্দন করতে তার চোখ দু’টি শ্বেতবর্ণ ধারণ করল ।অর্থাৎ,দৃষ্টিশক্তি লোপ পেল কিংবা দুর্বল হয়ে গেল।তাফসীিরবীদ মুকাতিল বলেন ঃ ইয়াকুব (আঃ) এই অবস্থায় ছয় বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল । এ সময় দৃষ্টিশক্তি প্রায় লোপ পেয়েছিল । অতঃপর তিনি স্তব্দ হয়ে গেলেন । কারও কাছে নিজের মনোবেদনা প্রকাশ করতেন না । উদ্দেশ্য এই যে ,দুঃখ ও বিষাদে তার মন ভরে গেল এবং মুখ বন্ধ হয়ে গেল । কারও কাছে তিনি দুঃখের কথা বর্ণনা করতেন না । যে ব্যক্তি ক্রোধ সংবরণ করে এবং শক্তি থাকা সত্বেও ক্রোধ প্রকাশ করে না ,আল্লাহ তা আলা তাকে বড় প্রতিদান দেবেন। এক হাদিসে আছে ,হাশরের দিন আল্লাহ তাআলা এরুপ লোকদেরকে প্রকাশ্য সমাবেশে এনে বলবেন ঃজান্নাতের নেয়ামতসমুহের মধ্যে যেটি ইচ্ছা গ্রহন কর।