খলিফা হযরত উমর (রা) রচনা

খোলাফায়ে রাশেদীনের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা) ৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত কুরাইশ বংশের  আলী গো েএর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তার ডাক নাম ছিল  আবু হাফস। উপাধি ছিল ফারুক।

পিতার নাম খাওাব  এবং  মাতার নাম হাতামা ।বংশধারা উধর্বতন  নবম পুরুষ কাব পর্যন্ত গিয়ে মুহাম্মদ (সা)  এর বংশের সাথে মিশেছে।তার গোএবর্ণ ছিল ঈষৎ রক্তিম ,মাথা ভাজ বিশিষ্ট,গাল স্বল্প মাংসল ,দাড়ি ঘন দেহ দীর্ঘকার ছিল । বাল্যকাল হতেই তিনি যথেষ্ট প্রতিপওি  অর্জন করেছিলেন। প্রাচিন আরব ঐতিহাসিক বালাজুরির বর্ণনা মতে মহানবি(সা) এর আবির্ভাবের  প্রাককালে কুরাইশ বংশের মাএ সতেরোজন শিক্ষিত ব্যক্তির মধ্যে হযরত উমর (রা) ছিলেন অন্যতম । তিনি একজন  খ্যাতনামা বক্তা ও কবি ছিলেন। পেশাগতভাবে ছিলেন  একজন ব্যবসায়ি।               বাণিজ্য উপলক্ষে সিরিয়া ও পারস্য ভ্রমণ করে বহু খ্যাতিসম্পন্ন লোকের  সংস্পর্শে আসেন। ফলে তার  অভিঙ্গতা ও চিন্তা ধারা সম্প্রসারিত হয়।

ইসলাম গ্রহণঃপ্রথম দিকে হযরত উমর (রা) ইসলামের ঘোর শএু ছিলেন  এবং কুরাইশ বংশের অন্যতম প্রভাবশালি ব্যক্তি হিসেবে নবদিক্ষিত মুসলমানদের নির্যাতন করতেন । এমন কি একদা তিনি রাসুল (সা) কে বধ করতে  উদ্যত হয়েছিলেন । কিন্তু তার অঙ্গাতসারে ভগ্নি ফাতিমা এবং ভগ্নিপতি ইসলাম গ্রহন করে । ইসলামে দিক্ষিত তার ভগ্নি ফাতিমার কন্ঠে কুরআনের সুমিষ্ট আয়াত শ্রবণ করে তিনি বিগলিত হয়ে যান । অতঃপর তিনি মন্‌ এমুগ্ধের ন্যায় রাসুল (সা) এর নিকট  উপনীত হয়ে ইসলাম গ্রহন করেন । হযরত উমর  (রা) প্রথম ব্যক্তি যিনি মক্কার বিধর্মিদেরকে  এক্িএত করে  তার ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন এবং মহানবি (সা) কর্তৃক ফারুক বা সত্য মিথ্যার প্রভেদকারী উপাধি লাভ করেন ।নবুওয়তের সপ্তম বছরে  হযরত উমর (র) এর ইসলাম গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । ইসলামের চরম শএু পরম ভক্তে পরিণত হওয়ার ফলে  ইসলামের শক্তি বহুগূন বেড়ে যায়।      খিলাফত গ্রহনের পূর্বে ইসলামের সেবা ঃ হযরত উমর (রা)  এর ইসলাম গ্রহনের পর মুসলমানরা প্রকাশে ধর্মপ্রচার শুরু করেন।তিনি নিজেও ইসলাম প্রচারে যোগ দেন এবং তার প্রভাবে  অনেক গোএ  ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয় । রাসুলুল্লাহ (স) মদিনায়  হিজরতের পূর্বে তিনি বিশজন  হিজরতকারীর একটি দল নিয়ে মদিনায় গমন করেন ।তিনি সর্বপ্রথম আযান ব্যবস্থার প্রস্তাব করেন  এবং পরবর্তিকালে তা ঐশীবানী দ্বারা অনুমোদিত হয় । তিনি মদিনায় হযরত মুহাম্মদ (স) এর সুখ -দুঃখ ও সমস্যাবলির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন । বদর ,ওহুদ,খন্দক,হুনাইন,খাইবার  প্রভৃতি যুদ্ধগুলোতে যোগদান করে তিনি  অসাধারণ বীরত্ব ,যোগ্যতা ও দায়িত্ববোধের  পরিচয় দিয়েছেন । খন্দকের যুদ্ধে মক্কাবাসীদের  আক্রমণের  প্রতিরোধে তিনি যে অপূর্ব সমরকুশলতার  পরিচয় দেন  এর স্বীকৃতি স্বরুপ তার নামানুসারে তথায়  একটি মসজিদ নির্মিত হয় । হুদায়বিয়ার সন্ধি স্বাক্ষরিত হওয়ার সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন ।ইসলামের স্বার্থের  প্রতি অত্যন্ত স্বচেতন ছিলেন বলে তিনি  এই চুক্তির বিরোধীতা করেছিলেন । কেননা  আপাতদৃষ্টিতে এ সন্ধি ন্যাক্কারজনক  বলে প্রতিয়মান হয়েছিল ।কিন্তু মহানবি (স) এ সন্ধি অন্তর্নীহিত সারবওার কথা বুঝালে তিনি  এতে সম্মত হন ।মক্কা বিজয়ের সময় তিনি কুরাইশ  নেতা আবু সুফয়ানকে বন্দি করেছিলেন ।তাবুক অভিজানে তার শ্রমলব্ধ সম্পদের অর্ধাংশ  যুদ্ধ তহবিলে দান করেন । এছাড়া তিনি তার খাইবার অঞ্চলে বিস্তির্ণ ভূ- সম্পওিও  ইসলামের সেবাই উৎসর্গ করেছেন। আল্লাহর রাসুলের প্রতি তার সুগভির শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল।তার মৃত্যুতে তিনি  পাগলের  ন্যায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন ।প্রথম খলিফা মনোনয়নের সময় যে বিক্ষুব্দ হয়ে উঠেছিলেন । প্রথম খলিফা মনোয়নের সময় যে বিপজ্জনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল তা দূরিকরণে হযরত উমর (রা) এর যথেষ্ট অবদান ছিল ।তিনি প্রথম খলিফা হিসেবে হযরত  আবু বকর (রা)  এর নাম প্রস্তাব করে তার প্রতি  আনুগত্যের শপথ গ্রহন করেছিলেন হযরত  আবু বকর (র) এর নাম প্রস্তাব করে তার প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহন করেছিলেন । হযরত আবু বকর (র)  এর খিলাফতকালে  তিনি তার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে  উদ্ভুত বিভিন্ন জটিল সমস্যা  সমাধানে সাহায্য করেন । তিনি বিচারকের দায়িত্ব ও পালন করেন ।

খিলাফত লাভ ঃইসলামের প্রথম খলিফা হযরত  আবু বকর (রা)জীবদ্দশায় তার উওরাধিকারী ইসলামি রাষ্ট্রের পরবর্তি খলিফা মনোনীত করে যাবার জন্য অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠলেন । পুর্ব ঘটনার পুনরাবৃওি যাতে না ঘটে  এর জন্য তিনি মৃত্যুর পূর্বে খিলাফতের একটি মমিাংসা করে যেতে চাইলেন।  অতীতের অভীঙ্গতা হতে তিনি হযরত উমর (রা) কে খিলাফতের গুরুদায়িত্বের  জন্য  উপযুক্ত বলে মনে করতেন । কেননা কঠোরতা ,ন্যায়নিষ্ঠাও জাগতিক কর্তব্য সম্বন্ধে হযরত উমর (রা) সাহাবাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ট ছিলেন । তবু তার নির্বাচনের স্বপক্ষে জনমত যাচাই করার জন্য অন্যান্য সাহাবাদের পরামর্শ নিতে চাইলেন ।সর্বপ্রথম তিনি আবদুর রহমান বিন আউফের পরামর্শ গ্রহন করলেন । হযরত আব্দুর রহমান (রা) বললেন হযরত উমরের যোগ্যতা সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই তবে তার স্বভাব বড় কঠোর প্রকৃতির । এর উওর হযরত আবু বকর (রা) বললেন তার নিজের উপর দায়িত্ব আসলে আপনা হতেই তিনি উদার হয়ে উঠবেন । এরপর তিনি হযরত উসমান (রা) এর সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করলেন । হযরত উসমান (রা) হযরত উমরের পক্ষে মত ব্যক্ত করবেন ।  এরপর হযরত আবু বকর (রা) অন্যান্য আনসার ও মুহাজিরদের মতামত নিলেন । তারা সকলেই হযরত উমর (রা) এর মনোনয়নকে সমর্থন করেন ।

হযরত তালহা (রা) মনোনয়নের যৌক্তিকতা সম্বন্ধ বললেন যে ,তার মতে হযরত উমর (রা) সাহাবিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। এরপর তিনি  হযরত উসমান (রা) কে ডেকে এনে হযরত উমরের (রা) এর পক্ষে  একটি মনোনয়ন পএ লিখে নিলেন । মনোনয়নপএ সম্পাদন এর পর হযরত আবু বকর (রা) উপস্থিত জনতাকে সম্বোধন করে বললেন ,ভাইসব আমি আমার কোন আত্মিয়-স্বজনকে খলিফা মনোনীত করিনি ,বরং হযরত উমর (রা) কে মনোনিত করেছি যাতে আপনারা এ সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট হন। এ কথা শুনে উপস্থিত জনতা সমবেত কন্ঠে বলে উঠল,আমরা আপনার কথা শুনলাম এবং মনোনয়ন মেনে নিলাম। অতঃপর খলিফা হযরত আবু বকর (রা) এর ইন্তেকালের পর ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে হযরত উমর (রা) ইসলামের ‍দ্বিতিয় খলিফারুপে খিলাফতে অধিষ্ঠিত হন।

খিলাফত লাভের পরপরই হযরত  উমর (রা)তার পূর্ববর্তী খলিফা হযরত আবু বকর (রা)  এর সীমান্ত নীতি  অনুসরণ করেন । ফলে মাএ দশ বছরের মধ্যে ক্ষুদ্র আরব উপদ্বীপকে উওর পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে সম্প্রসারণ করে তিনি তৎকালিন বিশ্বের দুই পরাশক্তি পারস্য ও বায়জান্টাইন  সাম্রাজ্য মুসলিম সাম্রাজ্যভুক্ত করেন । এ সময়ে বিস্ময়কর ও দুঃসাহসিক  সামরিক অভিযানগুলো সম্পর্কে অধ্যাপক  পি.কে হিট্টি বলেন ,খালিদ বিন ওয়ালিদ ও আমর বিন  আল আসের  ইরাক ,পারস্য ও মিসর  অভিযানসমুহের অন্যতম  এবং এগুলি নেপোলিয়ন,হ্যানিবল ও আলেকজান্ডারের পরিচালিত যুদ্ধগুলির সাথে তুলনীয়।

পারস্য বিজয় ঃ                                                             আরবের পূর্বদিকে  পারস্য সাম্রাজ্য অবস্থিত । ইরাক (মেসোপটেমিয়া ) হতে আমুদরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বর্তমান  ইরান নিয়ে পারস্য সাম্রাজ্য গঠিত ছিল। হযরত আবু বকর (রা) এর  শাসনামলে ইরাক ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে মুসলিম অভিযান পরিচালিত  হয়েছিল। মুসলমানরা যখন যু্দ্ধরত তখন  খলিফা হযরত  আবু বকর (রা) ইন্তেকাল করেন ।  নতুন  খলিফা হযরত  উমর (রা) এ সকল  অভিযানের  সাফল্যজনক  পরিসমাপ্তি ঘটাবার  জন্য বিশেষভাবে  তৎপর হন ।

পারস্য বিজয়ের কারণঃ হযরত উমর (রা) এর শাসনকালে কতিপয় কারনে পারস্যবাসির সাথে  মুসলমানদের  সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। এ সংঘর্ষের গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলোঃ

প্রথমতঃমুসলমানদের কোন  প্রকার উন্নতি এবং ইসলামের সমৃদ্ধি পারস্যবাসি  কোনোভাবেই সহ্য করতে পারত না এবং সর্বপ্রকারে তাদের ধ্বংস সাধনের চেষ্টায় লিপ্ত ছিল ।

দ্বিতীয়ত ঃমহানবি (স) কর্তৃক প্রেরিত মুসলিম দূতকে  অপমানিত করায় পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় খসরু  পারভেজ মুসলমানদের বিরাগভাজন হন। এভাবে  আন্তর্জাতিক নীতির  অবমাননা করায় এর প্রতিশোধ ব্যবস্থাস্বরুপ পারস্য বিজয় মুসলমানদের পক্ষে অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

তৃতিয়তঃ

রিদ্দা যুদ্ধের সময় বাহরাইনে যখন বিদ্রোহ সংঘটিত হয় , তখন পারস্যবাসী বিদ্রোহীদের প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য প্রদান করেন । পারস্যবাসীদের বিদ্বেষপুর্ণ ও শএুতামূলক  আচরণের  জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা  গ্রহন করতে মুসলমানগণ বাধ্য হন । এ হতে বুঝা যায় যে,খলিফা উমর (রা)  সাম্রাজ্যবাদী নীতি দ্বারা  পারস্য বিজয়ে উদ্বুদ্ধ হননি , পারস্যবাসীর শএুতা তাকে  হাতিয়ারধারণে বাধ্য করেছিল।

চতুর্থতঃ                                                                          ইরাকের উপর দিয়ে ইউফ্রেটিস ও  টাইগ্রিস  নদীদ্বয় প্রবাহিত হওয়ার ফলে  এটা  অত্যন্ত উর্বর এবং সমৃদ্ধশালী দেশ হিসাবে পরিগণিত হয়। ইরাকের সাথে  আরববাসীদের বাণীজ্যিক সম্পর্ক ছিল । কিন্ত পারস্যবাসীরা  আরব মুসলিম  বণিকদের অব্যাহতভাবে তাদের দেশে  ব্যবসা বাণিজ্য করতে দিতে রাজি ছিল না । সুতরাং অর্থনৈতিক প্রয়োজনও  আরবগণ পারস্য বিজয়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল ।

পঞ্চমতঃ                                                                     ভৌগোলিক অবস্থানের  দিক দিয়ে  পারস্য  সাম্রাজ্যের  ইরাক  প্রদেশ  ছিল  আরব ভূখন্ডের সংলগ্ন। এজন্য আরববাসীর সাথে তাদের প্রায়ই সংঘর্ষ লেগে থাকত ।কাজেই রাজনৈতিক দিক দিয়ে নিরাপওার জন্যই  এতদ-অঞ্চলে মুসলমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা নেহায়েত  প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল । অধ্যাপক পি.কে হিট্টি বলেন, অন্য কোনো পূর্ব পরিকল্পনা  ছাড়া তৎক্ষনাৎ ঘটিত ঘটনাসমুহের  পরিপ্রেক্ষিতে বৃহওর  ইসলামি সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হয় । এ থেকে প্রমাণিত হয় যে ,সাম্রাজ্যবাদী নীতিতে  উদ্বুদ্ধ হয়ে  আরববাসী  মুসলমানদেরকে অস্‌েএধারণ করতে হয়েছিল ।

Leave a Comment