বক্ষ বিদারনের ঘটনা
ইবনে ইসহাক বলেন, সাওর ইবনে ইয়াযীদ কতীপয় বিদ্বান ব্যক্তির নিকট থেকে (আমার ধারণা, একমাএ খালিদ বিন মা’দান আল কালায়ীর নিকট থেকেই) বর্ণনা করেছেন যে,কতিপয় সাহাবী একবার হযরত রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন।তিনি বললেন হ্যাঁ শোনো। আমি পিতা ইবরাহীমের দোয়ার ফল এবং ভাই ঈসার সুসংবাদের পরিণতি। আমি গর্ভে আসার পর আমার মা স্বপ্নে দেখেন যে,তার মধ্য থেকে একটা জ্যোতি বেরুলো যা দ্বারা সিরিয়ার প্রাসাদসমুহ আলোকিত হয়ে গেলো। আর বনু সা’দ ইবনে বাকর গো েএ আমি ধাএীর কোলে লালিত-পালিত হই।এই সময় একদিন আমার এক দুধভাই-এর সাথে আমাদের (ধাএী মাতা হালিমার ) বাড়ির পেছনে মেষ চরাতে যাই।তখন সাদা কাপড় পরা দু’জন লোক আমার কাছে আসে ।তাদের কাছে একটা সোনার তশতরি ভর্তি বরফ ছিল।তারা আমাকে ধরে আমার পেট চিরলো। অতঃপর আমার হ্দপিন্ড বের তাও চিরলো এবং তা থেকে এক ফোটা কালো জমাট রক্ত বের করে তা ফেলে দিল ।তারপর ঐ বরফ দিয়ে আমার পেট ও হ্দপিন্ড ধুয়ে পরিষ্কার করে দিল।অতঃপর তাদের একজন অপরজনকে বললোঃমুহাম্মদকে (সাঃ) তার উম্মাতের দশজনের সাথে ওজন কর । সে আমাকে পরিমাপ করলো এবং আমি দশজনের চাইতে বেশি হলাম। অতঃপর তাদের একজন অপরজনকে বললোঃমুহাম্মদকে তার উম্মতের দশজনের সাথে ওজন কর। সে আমাকে পরিমাপ করলো এবং আমি দশজনের চাইতে বেশি হলাম।অতঃপর সে আবার বললোঃতাকে তার উম্মতের একশো জনের সাথে ওজন কর। সে একশো জনের সাথে আমাকে ওজন করলো। আমি ওজনে একশো জনের চাইতেও বেশি হলাম।অতঃপর সে আবার বললোঃ তাকে তার উম্মাতের একশো জনের সাথে ওজন কর। সে একশো জনের সাথে আমাকে ওজন করলো। আমি ওজনে একশো জনের চাইতেও বেশি হলাম। অতঃপর সে আবার বললোঃ তাকে তার উম্মাতের একশো জনের সাথে ওজন কর। সে একশো জনের সাথে আমাকে ওজন করলো। আমি ওজনে একশো জনের চাইতেও বেশি হলাম।অতঃপর সে আবার বললোঃ তাকে তার উম্মাতের এক হাজার জনের সাথে ওজন কর। আমাকে এক হাজার জনের সাথে ওজন করলে আমি এবারও ওজনে তাদের চাইতে বেশি হলাম। অতঃপর সে বললোঃতাকে তার উম্মাতের এক হাজার জনের সাথে ওজন কর । আমাকে এক হাজার জনের সাথে ওজন করলে আমি এবারও ওজনে তাদের চাইতে বেশি হলাম।অতঃপর সে আবার বললোঃ তাকে তার উম্মাতের এক হাজার জনের সাথে ওজন কর । আমাকে এক হাজার জনের সাথে ওজন করলে আমি এবারও ওজনে তাদের চাইতে বেশি হলাম। অতঃপর সে বললোঃ রেখে দাও,আল্লাহর কসম,তাকে যদি তার সমগ্র উম্মাতের সাথেও ওজন করা হয় তাহলেও তিনিই তাদের সবার চাইতে ওজনে বেশি হবেন।
দাদার অভিভাকত্বেঃ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তার মা আমিনা বিনতে ওয়াহাব ও দাদা আবদুল মুওালিব ইবনে হাশিমের জীবদ্দশায়ও আল্লাহর তদারক ও তওাবধানে ছিলেন। এই সময় আল্লাহ অতি দ্রুত তার শারীরিক প্রবৃদ্ধি দান করেন,যাতে আল্লাহর ইঙ্গিত অলৌকিকত্ব তার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যখন তার বয়স হয় ছয় বছর,তখন মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তি আবহাওয়া নামক স্থানে তার মতো ইনতিকাল করেন । সেখানে শিশু মুহাম্মদ (সা) কে সাথে নিয়ে তিনি বনী আদী ইবনে নাজ্জার গো েএ মুহাম্মদ (সা) মামাদের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিলেন।মক্কা অভিমুখে প্রত্যাবর্তনের সময় তিনি ইনতিকাল করেন । মায়ের ইনতিকালের পর হযরত রাসুল (সাঃ) দাদা আবদুল মুওালিবের একক তও্াবধানে লালিত পালিত হতে থাকেন । আবদুল মুওালিবের জন্য কাবা শরীফের ছায়ায় চাদরে বিছানো হতো। আবদুল মুওালিব সেখানে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত ঐ চাদরের আশে পাশে বসে থাকতো তার পৌএরা । আবদুল মুওালিবের সম্মানার্থে কেউ তার ওপর বসতো না। কিন্ত দৃঢ়চেতা কিশোর মুহাম্মদ (সাঃ) এসেই বিছানার ওপর গিয়ে বসে পড়তেন। তার চাচা তাকে ধরে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করতেন।তা দেখে আবদুল মুওালিব বলতেন,তোমরা আমার পৌএকে বাধা দিও না । আল্লাহর কসম সে এক অসাধারণ ছেলে ।অতঃপর তাকে সাথে নিয়ে চাদরের ওপর বসতেন এবং তার পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতেন। তার সব কাজই তার ভাল লাগতো। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বয়স আট বছর পূর্ণ হলে আবদুল মুওালিব মারা যান ।আবরাহার হস্তি বাহিনি নিয়ে কাবা শরীফ আক্রমণ করার আট বছর পর তিনি মারা যান। চাচা আবু তালিবের অভিভাবকত্বেঃ আবদুল মুওালিবের তিরোধানের পর রাসুলুল্লাহ (সা) তার চাচা আবু তালিবের কাছে লালিত-পালিত হতে লাগলেন।তৎকালে বনু লেহাব গো েএর এক ব্যক্তি মানুষের দৈহিক লক্ষণসমুহ দেখে ভাগ্য বিচার করতো। সে যখন মক্কায় আসতো, কুরাইশরা তাদের ছেলেদের নিয়ে তার কাছে ভীড় জমাতো। সে ছেলেদের শরীরের ওপরে নজর বুলিয়ে তাদের ভাগ্য বলতো।অন্যদের সাথে আবু তালিবও রাসুলুলুল্লাহ (সা)কে নিয়ে উক্ত গণকের কাছে গেলেন।গণক তার দিকে তাকালো এবং পরক্ষণেই যেন একটু ভাবতে আরম্ভ করলো। ক্ষণিকের জন্য সে বালক মুহাম্মদ (সা) এর কথা এড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর বললো,এই বালককে নিয়ে একটু বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে। আবু তালিব বালক মুহাম্মদের প্রতি গণকের অধিক মনোযোগ লক্ষ্য করে তাকে কৌশলে সরিয়ে দিলেন। এতে গণক বললো,তোমাদের এ কি কান্ড! বালকটাকে আমার কাছে আবার নিয়ে এসো। আল্লাহর কসম এ এক অসাধারণ বালক। পাদ্রী বাহীরার ঘটনাঃ কিছুদিন পরের ঘটনা। আবু তালিব এক কাফিলার সাথে সিরিয়ায় রওয়ানা হলেন বাণিজ্যেপক্ষে। যাএার প্রাক্কালে বালক মুহাম্মদ (সা) তার সথে যাওয়ার আবদার করলেন ।স্নেহবিগলিত চাচা তার আবদার উপেক্ষা করতে পারলেন না । তিনি বললেন ,আমি তাকে সাথে নিয়ে যাবো, তাকে রেখে আমি কক্ষনও কোথাও যাবো না । আবু তালিব তাকে সাথে নিয়ে সফরে বেরুলেন ।কাফিলা বুসরা এলাকায় পৌছলে যাএাবিরতি করলো। সেখানে ছিলেন বাহিরা নামে এক খৃষ্টান পাদ্রি। এক গীর্জায় তিনি থাকতেন ।ঈসায়ী ধর্ম সম্পর্কে তিনি ছিলেন খুবই পারদর্শি।দীর্ঘকাল ব্যাপি ঐ গীর্জায় একখানা আসমানি কিতাব রক্ষিত ছিলো। পুরুষানুক্রমে ঐ ধারণার উওরাধিকার চলে আসছিলো । বাহিরার কাছ দিয়ে ইতিপূর্বে তারা প্রায়ই আসা-যাওয়া করতেন।কিন্তু তিনি কারো সামনে বেরুতেন না বা কারো সাথে কথাবার্তা বলতেন না।কিন্তু তিনি কারো সামনে বেরুতেন না বা কারো সাথে কথাবার্তা বলতেন না।কিন্তু এই বছর যখন কুরাইশদের কাফিলা আবু তালিব ও বালক মুহাম্মদ (সাঃ) ঐ স্থানে বাহিরার গীর্জার পাশে যাএাবিরতির করলো তখন বাহীরা তাদের জন্য প্রচুর খাদ্যের ব্যবস্থা করলেন। কথিত আছে বাহিরা তার গীর্জায় বসেই একটা আশ্চর্য ব্যাপারে দেখতে পান ।তিনি কাফিলার এগিয়ে আসার সময় দেখেন যে, সমগ্র কাফিলার মধ্যে একমাএ বালক মুহাম্মদ (সা) কেই আকাশ থেকে একখন্ড মেঘ ছায়া দিয়ে চলছে।অতঃপর তারা একটা গাছের ছায়ায় যাএাবিরতি করলে মেঘ এবং সেই গাছের ডালপালা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ওপর ঝুকে ছায়া দিতে লাগলো। এ দৃশ্য দেখে বাহিরা গীর্জা থেকে বেরিয়ে আসলেন এবং লোক পাঠিয়ে কাফিলার লোকদেরকে বলে পাঠালেন,হে কুরাইশ বণিকগণ,আমি আপনাদের জন্য খাওয়ার বন্দোবস্ত করেছি। আপনাদের মধ্যে ছোটবড় দাস বা মনিব সবাইকে এসে খাদ্য গ্রহণ করতে অনুরোধ করছি। কুরাইশদের মধ্যে থেকে এক ব্যক্তি বললো,হে বাহিরা আজকে আপনি নতুন মহিমায় মন্ডিত হয়েছেন। ইতিপূর্বে আমরা বহুবার আপনার নিকট দিয়ে যাতায়াত করেছি। কিন্তু কখনো আপনি এরুপ আতিথেয়তা দেখাননি ।আজকে আপনার এরুপ করার কারণ কি? বাহিরা বললেন,সে কথা ঠিকই। আগে আমি কখনো এরুপ করিনি।তবে আজ আপনারা আমার অতিথি। তাই মনের ইচ্ছা আপনাদের যত্ন করি,আপনাদের জন্য তৈরী করি এবং আপনারা সকলেই খাবার গ্রহণ করুন।জনৈক কুরাইশী বললো,লাত- উযযার শপথ,আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুওালিবের ছেলে আমাদের সাথে থাকবে অথচ আমাদের সাথে খাবার গ্রহণ করবে না,এটা হতেই পারে না। এটা আমাদের জন্য নিন্দনীয় ব্যাপার। একথা বলেই সে উঠে গিয়ে বালক মুহাম্মদ (সাঃ) কে কোলে করে নিয়ে এলো এবং সবার সাথে খাবারের বৈঠকে বসিয়ে দিলো। এই সময় বাহীরা তার সমগ্র অবয়ব গভীরভাবে দেখতে লাগলেন এবং দেহের বিশিষ্ট নিদর্শনগুলো পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।তার বিবরণ তিনি পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবে পেয়েছেন।সমাগত অতিথিদের সকলের খাওয়া শেষ হলে এবং তারা এক এক করে সবাই বেরিয়ে গেলে বাহীরা তার সমগ্র অবয়ব গভীরভাবে দেখতে লাগলেন এবং দেহের বিশিষ্ট নিদর্শনগুলো পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।তার বিবরণ তিনি পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবে পেয়েছেন।সমাগত অতিথিদের সকলের খাওয়া শেষ হলে এবং তারা এক এক সবাই বেরিয়ে গেলে বাহিরা রাসুলুল্লাহ (সা) নিকট এসে বললেন,হে বৎস, আমি তোমাকে লাত ও উযযার দোহাই দিয়ে অনুরোধ করছি, আমি যা জিগ্যেস করবো তুমি তার জবাব দেবে। বাহিরা লাত ও উযযার দোহাই দিলেন এই জন্যে যে,তিনি কুরাইশদেরকে পরষ্পর কথাবার্তা বলার সময় ঐ দুই মূর্তির শপথ করতে শুনেছেন।রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন,আমাকে লাত-উযযার দোহাই দিয়ে কিছু জিগ্যেস করবেন না।আল্লাহর শপথ, আমি ঐ দুই দেবতাকে সর্বাধিক ঘৃণা করি।বাহিরা বললেন,আচ্ছা তবে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি,যা জিগ্যেস করবো তার জবাবে দেবে।রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন,বেশ কি কি জানতে চান বলুন।অতঃপর বাহিরা তাকে নানা কথা জিগ্যেস করতে লাগলেন। তার ঘুমন্ত অবস্থার কথা ,তার দেহের গঠন- প্রকৃতি ও অন্যান্য অবস্থার কথা। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তার সব প্রশ্নের যা জবাব দিলেন,তা বাহিরার জানা তথ্যের সাথে হুবহু মিলে গেল। তারপর তিনি তার পিঠ দেখলেন।পিঠে দুই স্কন্ধের মধ্যবর্তী স্থানে নবুওয়াতের মোহর অংকিত দেখতে পেলেন।মোহর অবিকল সেই জায়গায় দেখতে পেলেন যেখানে বাহিরার পড়া আসমানী কিতাবের বর্ণনা অনুসারে থাকার কথা ছিল। এসব করার পরে বাহিরা আবু তালিবকে জিগ্যেস করলেন, বালকটি আপনার কে? তিনি বললেন,‘‘আমার ছেলে। বাহিরা বললেন,সে আপনার ছেলে নয়। এই ছেলের পিতা জীবিত থাকতে পারে না। আবু তালিব বলেলেন,বালকটি আমার ভ্রাতুষ্পুএ। বাহিরা বললেন,ওর পিতার কি হয়েছিল? আবু তালিব বললেন,এই ছেলে মায়ের পেটে থাকতেই তার পিতা মারা গেছে। বাহিরা বললেন,ঠিক এ রকম হওয়ার কথা। আপনার ভ্রাতুষ্পুএকে নিয়ে গৃহে ফিরে যান।খবরদার,ইয়াহুদিদের থেকে ওকে সাবধানে রাখবেন। আল্লাহর কসম,তারা যদি এই বালককে দেখতে পায় এবং আমি তার যে নিদর্শন দেখে চিনেছি তা যদি চিনতে পারে তাহলে তারা ওর ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করবে।কেননা আপনার এ ভ্রাতুষ্পুএ অচিরেই এক মহামানব হিসাবে আবির্ভুত হবেন।অতঃপর তাকে নিয়ে তিনি তাড়াতাড়ি স্বদেশে ফিরে গেলেন।