বদরের যুদ্ধ

হিজরতের পর মদিনায় ইসলামের দৃঢ় প্রতিষ্ঠা ও প্রসার ,হযরত মুহাম্মদ (স) -এর প্রভাব  প্রতিপ িএ বৃদ্ধি ও কর্মকান্ডে সাফল্য লাভ এবং মদিনা নগরীর শাসন শৃঙ্খলা  উন্নত হওয়ায় মক্কার কুরাইশদের মনে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভের সঞ্চার হয় ।এই ঈর্ষা ও শএুতা থেকেই পৌওলিক মক্কাবাসী  মহানবী (স) এর সঙ্গে প্রথম যে সংঘর্ষর  সূএপাত ঘটায় ইসলামের ইতিহাসে তা গাজওয়ায়ে বদর  বা বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত।

বদরের যুদ্ধের কারনঃ                                                                                                        মদিনায় ধর্মভিওিক ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামকে  আন্তর্জাতিকীকরণে মহানবির  প্রচেষ্টায় মক্কা কুরাইশগণ ঈর্ষাণিত হয়। তারা জন্মভূমি মক্কা হতে হযরত মুহাম্মদ (স) কে বিতাড়িত করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং তার প্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্রকে সমুলে ধ্বংস করার জন্য ষড়যন্ এ ও যুদ্ধপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।

আবদুল্লাহ ইবনে  উবাই-এর ষড়যন্ এ ঃ                                                                       হযরত মুহাম্মদ(স)  এর অসামান্য প্রাধান্য খর্ব করার জন্য  বানু খাযরাজ  বংশীয়  আব্দুল্লাহ বিন উবাই নামক  একজন  প্রতিপওিশালী  মুনাফিক নেতা গোপনে ষড়যন্েএ করতে থাকে । কেননা হিজরতের পূর্বে মদিনায় তার শাসকরুপে অধিষ্ঠিত হবার কথা ছিল ;কিন্তু ইসলামি প্রজাতন্‌েএ প্রতিষ্ঠা ও মদিনা সনদের পরিপেক্ষিতে  তার আশা পূর্ণ হয়নি । এর ফলে সে মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে দুরভিসন্ধিমুলক কার্যকলাপে নিয়োজিত হয় এবং মদিনায় হযরত মুহাম্মদ (স) -এর বিরুদ্ধে প্রচারণা ও বিরুদ্ধাচারণ দ্বারা একটি মুনাফিক দল  হযরত মুহাম্মদ (স) এর বিরুদ্ধে শএুতা করেন ।

 মদিনার ইহুদিদের ষড়যন্‌েএঃ                                                                                     মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় প্রথমে হযরত মুহাম্মদ (স) কে সানন্দে বরণ করলেও তার ক্রমবর্ধমান প্রতিপওি ‍ও সুনাম তাদেরকে অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ করে তোলে । মদিনা সনদে তাদেরকে সকল প্রকার ধর্মিয় ও নাগরিক স্বাধীনতা  প্রদান সত্বেও  ইহুদিগণ কোনদিনই মুসলমানদের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব প্রকাশ করেনি । উপরন্তু মদিনা সনদের শর্ত লংঘন করে তারা কুরাইশদের সঙ্গে ষড়যন্‌েএ ও গুপ্ত সংবাদ প্রেরণ করে  ইসলাম ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিলোপ সাধন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে ।এমনকি তারা মদিনা আক্রমনের জন্যে শএুদেরকে প্ররোচিত করতে থাকে ।সৈয়দ আমির আলি যথার্থই মন্তব্য করেন, সমগ্র মদিনা বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতায় ভরে গিয়েছিল।

আর্থীক কারনঃ                                                                                                                   মক্কা হতে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্য পথে মদিনা অবস্থিত ছিল। এই জন্য আর্ন্তজাতিক বাণিজ্য মদিনার গুরুত্ব অপরিসীম ।বাণিজ্য পথ ব্যতিত  এই পথটি হজ্জ যা িএদের  জন্যেও অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল ।মুহাম্মদ (সা)কর্তৃক মদিনায  ইসলামি প্রজাতন্েএ প্রতিষ্ঠিত হলে কুরাইশগণ নির্বীঘ্নে ব্যবসা বাণিজ্য করার সুযোগ হারাতে পারে এ আশঙ্কায় মদিনার  ইসলামি রাষ্ট্রের পতন ঘটানোর জন্য তারা যুদ্ধের  প্রস্তুতি করতে থাকে ।

কুরাইশদের হিংসাত্মক কার্যকলাপ ঃ                                                                             পবিএ কাবা গৃহের রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকার সমগ্র আরবের পৌওলিকদের মধ্যে কুরাইশদের অপরিসীম প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ।মক্কা ও মদিনার বাণিজ্য পথে বসবাসকারি বিভিন্ন আরব গোএ কুরাইশদের সাথে গোপনে যোগসূএ স্থাপন করে  হযরতের বিরুদ্ধাচারণ করতে থাকলে মুসলমানদের নিরাপওার অভাব দেখা দেয়।মদিনার সীমান্তবর্তী এলাকায় কুরাইশগণ অথবা তাদের সাহায্যকারি  আরবগোএ মুসলমানদের শস্যক্ষেএ জ্বালিয়ে দিত,ফলবান বৃক্ষ ধ্বংস করতো এবং উট ও ছাগল অপহরণ করত ।এই প্ররোচণামূলক ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য মহানবি (সাঃ) আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহন করেন ।

নাখলারখন্ডযুদ্ধঃ                                                                                                     কুরাইশদের  ক্রমবর্ধমান আক্রমণ ও লুটতরাজ বন্ধ করার জন্য মহানবি (সা) হযরত  আবদুল্লাহ  ইবন জাহাশের নেতৃত্বে ১২ জনের একটি গোয়েন্দা দল সীমান্তবর্তী এলাকায়  প্রেরণ করেন । হযরতের নির্দশ অনুযায়ি তিনদিন পর সীলমোহরকৃত আদেশপএ উম্মোচন করে হযরত আবদুল্লাহ সঙ্গিদের নিয়ে নাখলার দিকে অগ্রসর হওয়ার এবং মক্কা কাফেলার জন্য অপেক্ষা করার নির্দেশ পেলেন । লক্ষণিয় যে মহানবি (স) কাফেলার উপর  আক্রমণ করতে আদেশ করেন নি । কিন্তু হযরত আবদুল্লাহ (রা.)ভুলক্রমে চারজন যাএীর মক্কার এক কাফেলার  উপর আক্রমণ করলে নাখলায় একটি খন্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এর ফলে কুরাইশ নেতা আমর বিন হাযরামি নিহত ও অপর দুইজন বন্দি হয় ।নাখলার খন্ড যুদ্ধকে বদরের যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে গণ্য করা হয় ।কিন্তু এটি ছিল একটি  অজুহাত মাএ । কেননা তারা অনেকদিন  আগ থেকেই  ইসলামের উওরোওরের  শক্তি বৃদ্ধিতে  চিন্তিত হয়ে এর ধ্বংস সাধনে প্রবৃও হয় ।

আবু সুফিয়ানের কাফেলা  আক্রমণের মিথ্যা গুজব ঃ ইসলামের ঘোরতর শএু  আবু সুফিয়ান হাতিয়ার সংগ্রহের জন্য বাণিজ্যের  অজুহাতে  এক কাফেলা নিয়ে সিরিয়া গিয়েছিল ।নাখলা যুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়ে কুরাইশগণ মক্কার কাফেলার নিরাপদ  প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়ে । এসময় ্েকে ভিওিহীন জনরব উঠল যে ,আবু সুফিয়ানের কাফেলা মদিনার মুসলমান অধীবাসিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে ।এ গুজবের সত্যতা যাচাই না করেই  আক্রমণাত্বক নীতি অনুসরণ করে আবু জাহল ১০০০ সৈন্য নিয়ে  আবু সুফিয়ানের সাহায্যার্থ মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হয় ।        বদর যুদ্ধের ঘটনা 

এমতাবস্থায় মহানবী (সা) ঐশিবাণি লাভ করে  অনুপ্রাণিত হলেন । ওহি নাযিল হয় আল্লাহর পথে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে ‘’।সাথে সাথে মহানবি (স) নেতৃস্থানীয়  সাহাবাদের পরামর্শে যুদ্ধে  অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন ।এরই ধারাবাহিকতায় আনসার এবং মুহাজির  নিয়ে গঠিত মাএ ৩১৩ জনের একটি মুসলিম বাহিনী কুরাইশ বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্যবদর অভিমুখে রওয়ানা হয়।

মদিনা থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণ পশ্চিম বদর উপত্যকায়৬২৪খ্রিষ্টাব্দে১৩মার্চ(১৭ই রমযান জুমাআ বার  দ্বিতীয় হিজরি) মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে কুরাইশদের সংঘর্ষ হয়। হযরত মুহাম্মদ (সা) স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করেন । আল ওয়াকিদী বলেন -হযরত মুহাম্মদ(সা) মুসলিম সৈন্য সমাবেশের জন্য এমন একটি স্থান বেছে নেন যেখানে সূর্যদয়ের পরে যুদ্ধ শুরু হলে কোন মুসলমান সৈন্যর চোখে সূর্য কিরণ পড়বে না ।প্রথমে প্রাচীন আরব রেওয়াজ অনুসারে মল্লযুদ্ধ হয়। এতে শএুপক্ষীয় নেতৃবৃন্দ শোচনীয়ভাবে  পরাজিত ও নিহত হয়। উপায়ান্তর না দেখে আবু  জাহলের নেতৃত্বে কুরাইশগণ মুসলমানদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে ।তারা মুসলমানদের উপির প্রচন্ডভাবে আক্রমণ চালাতে লাগল ।কিন্তু প্রতিকুল অবস্থায় সংঘবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলা করা কুরাইশদের পক্ষে সম্ভব হয়নি ।অসামান্য রণ -নৈপুণ্য, অপূর্ব বিক্রম ও অপরিসীম নিয়মানুবর্তীতার সঙ্গে যুদ্ধ করে মুসলমানগণ কুরােইশগণকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন । এ যুদ্ধে ৭০ জন কুরাইশ সৈন্য নিহত হয় ও সমসংখ্যক সৈন্য বন্দি হয়।অপরদিকে মাএ ১৪জন মুসলিম সৈন্য শাহাদাত বরণ করেন । আবু জাহল এ যুদ্ধে নিহত হয়। হযরত মুহাম্মদ(স)  যুদ্ধবন্দিদের প্রতি যে উদার ও মধুর ব্যবহার করেন  তা তাঁর মতানুভবতার পরিচয় বহন করে ।মুক্তিপণ গ্রহণ করে কুরাইশ বন্দিদেরকে মুক্তি প্রদান করে ও মুসলমান বালককে শিক্ষাদান করে মুক্তি লাভ করে ।

বদর যুদ্ধের গুরুত্ব

সামরিক প্রঙ্গার পরিচয় ঃবিশাল কুরাইশ বাহিনী স্বল্পসংখ্যক মুসলিম সৈন্যর নিকট শোচনীয়ভাবে  পরাজিত হলে  অমুসলিমরা  ইসলাম ধর্ম ও মদিনা রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি সম্বন্ধে ভীত হয়ে উঠে । সৈন্যসংখ্যা যুদ্ধে ভাগ্র নির্ধারণ করে এ ধারণা ভ্রান্তিতে পরিণত হয় এবং মুসলমানদের ভবিষ্যতের যুদ্ধ জয়ের এক দূর্বার  আকাঙ্খায় উদ্বুদ্ধ করে ।

ইসলাম প্রচারের ‍সুযোগ সৃষ্টিঃ বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় ইসলামি প্রজাতনেএর সম্প্রসারণের সুচনা করে এবং পরবর্তী একশ বছরের মধ্যে (৬২৪-৭২৪) ইসলাম পশ্চিমে  আফ্রিকা হতে পূর্ব ভারতবর্ষ ও মধ্য এশিয়া  পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে । যোসেফ হেল বলেন -পরবর্তীকালে সমস্ত সামরিক বিজয়  এ যুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রদরর্শীত ও বিকশিত  আরব গুনাবলির জন্যই সম্ভব হয় ।যথা-শৃঙ্খলা  ও মৃত্যুর  প্রতি অবহেলা ।হযরত মুহাম্মদ (স) যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে আদেশ  দেন ,তোমরা কেও সারি ভেঙ্গে এগিয়ে যেও না এবং আমার আদেশ না পাওয়া যুদ্ধ শুরু করো না ।

চুড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণকারী যুদ্ধঃ                                                                                        মক্কার প্রায় এক সহস্র বীর সেনার বিরুদ্ধে তিনশত তের জন  মুসলমানের যুদ্ধাভিযান  যে অঙ্গতার বিরুদ্ধে ইলমের ।অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের সংঘর্ষ  তা নিশ্চিতরুপে  বলা যেতে পারে। এ যুদ্ধে জয়লাভ  না করলে  ইসলাম শুধু রাষ্ট্র হিসেবে নহে ধর্ম হিসেবেও পৃথিবীর বুক হতে চিরতরে নিশ্চিন্হ হয়ে যেত ।

মুসলমানদের আত্ববিশ্বাস বৃ্দ্ধিঃ

বদরের যুদ্ধ মুষ্টিমেয়  মুসলমানদের মনে  আত্ববিশ্বাস সৃষ্টি করে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জিহাদের অনুপ্রেরণা প্রদান করে ।তাদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে  যে আল্লাহ স্বয়ং তাদের সাহায্যকারি ।ধর্মযুদ্ধে জীবিত অবস্থায়  গাজী ও মৃত্যুতে শহীদ হওয়ার প্রেরণা ও পারলৌকিক পুরষ্কার লাভের বাসনা তাদের পরবর্তি বিষয়গুলোতে প্রভাব বিস্তার করে ।

রাজনৈতীক নেতা হিসেবে মুহাম্মদ (সা) এর স্বীকৃতিঃ    বদরের যুদ্ধ বিজয় ইসলাম প্রচারে নব দিগন্তের সূচনা করে ।ইসলামের মর্যাদা ও দক্ষতা বৃদ্ধির কথা এবং গুরুত্বপূর্ন ফলাফলের কথা চিন্তা করে নিকলসন বলেন ,        বদরের যুদ্ধ ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় যুদ্ধের অন্যতম ।বদরের প্রান্তরে বিজয় লাভের ফলে সকলের দৃষ্টি মুহাম্মদ (স) এর উপর নিবন্ধ হলো ।আরবগণ তার ধর্মকে যতই   অপেক্ষা করুক না কেন ,তাকে সম্মান না করে পারল না ।এ যুদ্ধ ইসলামকে মদিনা প্রজাতনে্‌ েএর  ধর্ম হতে একটি সুসংঘবদ্ধ রাষ্ট্রের ধর্মে উন্নিত করে ।

ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের মনে ভীতি ঃ  ইহুদি  ও খ্রিষ্টান আরবগণ  ইসলামের অসীম ক্ষমতার বিরুদ্ধাচরণ  হতে সাময়িকভাবে বিরত থাকল ।মুনাফিকগণ ধর্মদ্রোহিতার জঘন্য পাপচার হতে ক্ষনিকের জন্য নিবৃও  রইল ।বিধর্মিরা  হযরতের  ঐশ্বরীক ক্ষমতায়  আকৃষ্ট হল  এবং মুসলমানগণ বদরের বিজয়কে  আল্লাহর প্রতিশ্রুত পুরষ্কার স্বরুপ গ্রহণ করে তাওহিদ ও নবুয়তে বিশ্বাস।

বিশ্ব বিজয়ের সূচনা ঃবদরের যুদ্ধের মহাবিজয় ইসলামকে কেবল  আরবেই নই ,অনারব অঞ্চলও সার্বজনীন করে তোলে ।এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকার জনৈক লেখক বলেন ,বদরের যুদ্ধে শুধু একটি বিখ্যাত  যুদ্ধই নয় এর ঐতিহাসিক গুরুত্বও  অপরিসিম ।

Leave a Comment