মসজিদে আকসা

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন,যে  ব্যক্তি একই বছর হজ্জ করে এবং মসজিদ নবওয়ী ও মসজিদে আকসায় নামায পড়ে,সে মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ নবজাত শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে যায়।                                                                               হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে আরো বর্ণিত।রাসুলুল্লাহ (সা) ঐতিহাসিক মিরাজ বা আসমানি সফর অনুষ্ঠিত হয়।সেই মিরাজের প্রতি নির্দ্বিধায় বিশ্বাস স্থাপন করে হযরত আবু বকর (রা) সিদ্দিক উপাধি লাভ করেন । মিরাজের প্রতি বিশ্বাস মুসলমানদের ঈমানের অঙ্গবিশেষ।এ প্রসঙ্গে আল্লাহ কুরআনে বলেছেন,তিনি নবি জিবরীল (আ)কে সিদরাতুল মুনতাহার কাছে দেখেছেন। সেখানে রয়েছে জান্নাতুল মাওয়া।যখন সিদরাহকে ঢেকে রেখেছিল সেই জিনিস,যা তাকে ঢেকে রাখে। (নবির)চোখ ভুল দেখেনি এবং আদেশ অমান্য করেনি। তিনি তার রবের বিরাট নিদর্শন দেখতে পেয়েছেন।(সূরা নাজমঃ১৩-১৮)                                      সেই ঐতিহাসিক মিরাজ উপলক্ষে রাতে রাসুলুল্লাহ (সা) নেতৃত্বে ফেরেশতারা মসজিদে আকসায় সমবেত হয়েছিলেন। সেখানেই তিনি আম্বিয়ায়ে কিরামকে সাথে নিয়ে নামায পড়েন ও নিজে নামাজের নেতৃত্ব দেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ বুঝিয়ে দেন যে ইমাম ও ইমামতির কেন্দ্র পরিবর্তিত হয়ে  তা মক্কায় স্থানান্তরিত হয়ে গেছে।                                           বাইতুল মাকদিসের হিফাযত বিরাট  ইসলামি দায়িত্ব।রাসুলুল্লাহ (সা) মুসলমানদেরকে সেই দায়িত্ব-কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে তাগিদ দিয়ে বলেছেন,হে মুআজ! আল্লাহ আমার পরে তোমাকে সিরিয়ার উপর বিজয় দান করবেন।মিসরের আরীস থেকে ইরাকের ফোরাত পর্যন্ত তোমরা বিজয় লাভ করবে। তাদের নারী ও পুরুষেরা কিয়ামাত পর্যন্ত এই ভূমির হেফাযতে নিয়োজিত থাকবে। তোমাদের কেউ যদি সিরিয়া উপকূল কিংবা বাইতুল মাকদিসকে বসবাসের জন্য নির্বাচন করে ,সে কিয়ামাত পর্য ন্ত জিহাদের মধ্যে নিয়োজিত বলে পরিগণিত হবে।                            বাইতুল মাকদিস প্রথম দিন থেকেই আল্লাহর একটি স্ট্রাটেজিক বা কৌশলগত স্থান। এই কারণে তিনি মেরাজের ঘটনার মাধ্যমে তাকে ইসলামের অধীন করে দিয়েছেন।                                                                  অনেকে মসজিদে আকসাকে মক্কা ও মদিনার দুই হারাম শরীফের মত ৩য় হারাম শরীফ নয়। অনুরুপভাবে,শেখ আবু বকর আবু যায়েদ ও তার মুজাম আল-মানাহী আল্লাফজীয়া গ্রন্থে এবং শেখ মোহাম্মদ সালেহ ওসাইমিন তার ফারায়েদুল ফাওয়ায়েদ গ্রন্থে একই কথা বলেছেন।                            ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মতে ,জেরুসালেমের হারাম শরীফ কিংবা আল-খলীল শহরের মসজিদ ইবরাহিমকে হারামে ইবরাহিমি বলা ঠিক  নয়। তার মতে  বাইতুল মাকদিসে হারাম শরীফ নামে কোন স্থান নেই।                                                                                       মসজিদে আকসার বর্ণনাঃ                                                  পরিবেষ্টিত এলাকার দক্ষিণাংশে মসজিদে আকসার বর্তমান ভবন অবস্থিত।মসজিদে সাখরা ,মসজিদে আকসা এবং অন্যান্য সেবা ভবনসহ চার দেয়ালের ভেতরের মোট জমির পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ৪০ হাজার ৯শ বর্গমিটার। মসজিদে আকসা মসজিদে সাখরা থেকে ৫শ মিটার দক্ষিণে অবস্থিত।একই সীমানার ভেতর আরো রয়েছে মসজিদে উমার ও জামে  নিসা। 

পশ্চিম দেয়াল থেকে মসজিদে আকসার  উওর-পশ্চিম কোণের দূরত্ব হচ্ছে প্রায় ৭০ মিটার ।মসজিদের সীমানার দেয়াল থেকে উওর ও দক্ষিণে একটি সরল রেখা টানলে পূর্ব ও পশ্চিমে ২৮৫ মিটার সমান দূরত্ব পাওয়া যায়। উওর দিক থেকে মসজিদের ৭ টি দরজায় যাওয়ার পথ আছে।এই ৭টি দরজা ছাড়াও মসজিদের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে  আরো ২টি দরজা আছে। মসজিদের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে রয়েছে মহিলাদের পৃথক প্রবেশ পথ।মসজিদে আকসার পূর্ব দিকে জামে উমার নামে আরেকটি মসজিদ আছে।জেরুসালেম বিজয়ের সময় হযরত উমার (রা)সেখানে যে মসজিদ তৈরী করেছিলেন বর্তমান মসজিদ তারই অবশিষ্টাংশ।                                                                       মসজিদে অনেকগুলো স্তম্ভ আছে। এগুলোতে খুবই সুন্দর নকশা অংকন করা হয়েছে। মসজিদের উওর-পশ্চিমে রয়েছে সুন্দর ও মনোরম নকশা খচিত মেহরাবে যাকারিয়া।                                              মসজিদে আকসায় অনেকগুলো গম্বুজ আছে। সেগুলো হচ্ছে ১ সিলসিলাহ গম্বুজ ২.সুলাইমান গম্বুজ ৩নাহওইয়া গম্বুজ ৪শেখ খলীল ৫.খিদির গম্বুজ ৬.মেরাজ গম্বুজ ৭ মূসা গম্বুজ ৮.ইউসুফ গম্বুজ ৯.মেহরাবুন্নবী গম্বুজ                                                                                  মসজিদে আকসায় অজু ও পানি পান করার কয়েকটা জায়গা আছে ।সেগুলোর মধ্যে সাবিল কায়েতবায়,সাবিল বুদাইরী,সাবিল শালান এবং সাবিল বাবুল হাবস অন্যতম।                                                                    মসজিদে আকসার দক্ষিণ দেয়াল খুবই মজবুত ।ফলে মসজিদে আকসার ১১ টা দরজা আছে। সেগুলো হচ্ছে উওরদিকে ৭টি,পূর্বদিকে ১টি পশ্চিমে ২টি এবং দক্ষিণে ১টি দরজা।সেগুলোর নাম হলো ১বাবুল আসবাত ২ বাবুল মাগারেবা৩বাবুল গাওয়ানিমা ৪বাবুস সিলসিলা ৫বাবুল হাবস ৬বাবুন নাযির ৭বাবুল কাওান ৮াবাবে হিওাহ ও৯ বাবে শারফিল আম্বিয়া বা বাবে ফয়সল ইত্যাদি ।দক্ষিণ দিকে জামে আন নিসা নামে মহিলাদের জন্য একটি মসজিদ আছে।  উমাইয়া খলিফাহ আবদুল মালেক বিন মারওয়ান প্রথমে মসজিদে সাখরার সংস্কার ও পুনঃনির্মাণ করেন। তিনি মসজিদে আকসার নির্মাণ কাজ শুরু  করলেও তা শেষ করতে পারেননি। ৭২হিঃ মোতাবেক ৬৯০ খৃঃ তার  ছেলে ওয়ালিদ বিন আবদুল মালেক মসজিদে আকসা নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করেন। মসজিদে আকসার দৈর্ঘ্য৮০ মিটার ও প্রস্থ৫৫মিটার।এতে মারবেল পাথরের তৈরী মোট৫৩ টি স্তম্ভ আছে এবং পাথরের তৈরী ৪৯টি বর্গাকৃতির খুঁটি আছে।স্তম্ভ ও খুটিগুলোর উচ্চতা হচ্ছে ৫ মিটার । এগুলোর উপর ৯মিটার চওড়া পাথরের ধনুক নির্মাণ করা হয়েছে এবং এর উপর নির্মিত হয়েছে ছাদ।স্তম্ভগুলোকে তামার তৈরি পাত দ্বারা মোড়ানো হয়েছে। মসজিদের মাঝামাঝি স্থানে রয়েছে বিরাট গম্বুজ।শিশা দ্বারা গম্বুজের চারদিক ঢালাই করা হয়েছে।  মসজিদের সামনের গম্বুজটি ১৭ মিটার উচু ও তাতে মোজাইক করা হয়েছে । এতে বহু কারুকার্য করা হয়েছে।                                                মসজিদে কিবলার দিকে মিম্বার নুরুদ্দিন ও মেহরাব সালাহউদ্দিন অবস্থিত। মসজিদে একটা বড় মেহরাব  আছে যা মিম্বার থেকে পূর্বদিকে অবস্থিত।এর নামকরণ করা হয়েছে মেহরাবে দাউদ।তারপর  লোকেরা এর নামকরণ করেছে মেহরাবে উমার।মসজিদের শুরুতে মিম্বার থেকে পশ্চিমে আরেকটি মেহরাব  আছে।একে মেহরাবে মুআওইয়াহ বলা হয়।                                                                 মসজিদে আকসার ভবন পূর্ব সীমানার দেয়াল পর্যন্ত পৌছেনি ।কেননা হযরত উমার (রা) লোকদেরকে পশ্চিম সীমানায় মসজিদ ভবন নির্মানের নির্দেশ দেয়ায় তখন থেকে পূর্বাংশ খালি পড়ে আছে। মসজিদে আকসার  সীমানার ভেতর কয়েকটি মাদ্রাসা তৈরী হয়েছে। সেগুলো হল,মাদ্রাসা নাহওইয়া, মাদ্রাসা নাসারিয়া ও মাদ্রাসা ফারেসিয়া। মসজিদে আকসা ইসলামি  সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।এতে তাফসীর,হাদীস,ফিকহসহ বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষা দান করা হয়। অনেক দিন পর্যন্ত মসজিদে আকসায় ৪ মাজহাবের ৪ জন ইমামের মাধ্যমে নামাযের ব্যবস্থা আন্জাম দেয়া হতো।এর ফলে তা বিরাট ইসলামী শিক্ষার ক্ষে েএ পরিণত হয়।পরবর্তীতে মাজহাব-ভিওিক ইমামতির পদ্ধতি বাতিল করা হয়।মসজিদে আকসার চারপাশে অনেকগুলো গরীব বোর্ডিং আছে। যেয়ারতকারী গরীব মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তি বা সংস্থা তা কায়েম করেছেন। মসজিদে আকসার পশ্চিম দেয়ালকে বোরাক শরীফ বলা হয়। এতে রাসুলুল্লাহর (সা) বোরাক বাধা হয়েছিল।ইহুদিরা এটাকে আল হায়েত আল মাবকি বলে ।এই দেয়ালটি বিরাট পাথর দ্বারা নির্মিত। এর দৈর্ঘ্য হচ্ছে ১৫৬ ফুট এবং উচ্চতা ৬৫ ফুট।ইহুদিদের দাবী হচ্ছে, এটি হাইকালে সুলাইমানীর অবশীষ্টাংশ।কিন্তু বর্তমানে তা মসজিদের আঙিনার অংশ ও মসজিদের ওয়াকফ বিভাগের মালিকানাধীন।                                                                                            মসজিদে আকসার দরজাগুলোতে অতি বেশি নকশা ও সুন্দর ডিজাইন করা হয়েছে।১৯২২খৃঃ মসজিদে আকসা সংস্কার সংস্কার সংক্রান্ত সর্বোচ্চ ফিলিস্তিনী কমিটি মসজিদের প্রয়োজনীয় সংস্কার ও মেরামতের জন্য মিসর ও তুরস্কের প্রকৌশলীদেরকে আহ্বান করে। কমিটি অনুসন্ধান চালিয়ে দেখে,মসজিদের বিভিন্ন খুটি ও স্তম্ভগুলোতে ফাটল ধরেছে এবং এগুলোর পক্ষে আর মসজিদের ছাদ বহন করা সম্ভব নয়। তারা মসজিদের নকশা ও ডিজাইন বহাল রেখে মেরামতের কাজ শেষ করেন।১৯২৭ খৃঃ মোতাবেক ১৩৪৬ হিঃ মসজিদে আকসার গম্বুজ সংস্কার করা একই বছর ভূমিকম্পে মসজিদের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফাটল ধরে।১৯৩৮খৃঃ উক্ত ফাটল মেরামত করা হয়।বিভিন্ন সংস্কারের সময় মসজিদে আকসার নকশা ও কারুকার্য অক্ষুন্ন রাখা হয় ।এটি পৃথিবির একটি সুন্দর স্থাপত্য কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত ।                                                                                            উমাইয়া খলিফাহ  আবদুল মালেক বিন মারওয়ান ৭০ হিজরি মোতাবেক ৬৯১ খৃঃ মসজিদে সাখরা নির্মাণ করেন।ঐতিহাসিকরা এ বিষয়ে একমত  যে ভূপৃষ্ঠে এটিই হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট ও সুন্দর স্থাপত্য নিদর্শন। সাখরা শব্দের অর্থ হচ্ছে পাথর। এই পাথরের রয়েছে তাৎপর্যপুর্ণ ইতিহাস । বর্ণিত আছে হযরত আদম (আ) সর্বপ্রথম এই পাথরের কাছে নামায পড়েছেন। হযরত ইবরাহিম (আ) এর কাছে নিজ ইবাদতগাহ নির্মাণ করেছেন। এই পাথরের  উপর আগুনের স্তম্ভ দেখে হযরত ইয়াকুব (আ) সেখানে একটা মসজিদ নির্মাণ করেন। হযরত ইউশা (আ) এর উপর একটা  গম্বুজ নির্মাণ করেন। তাকে কুবরাতুজ জামান বলা হয়। হযরত মুসা (আ) তীহ ময়দানে ওহি লাভের উদ্দেশ্যে বৈঠকের জন্য যে তাবু নির্মাণ করেছিলেন,                                                                                                                 পরবর্তিতে তাকে এই পাথরের কাছে স্থাপন করা হয়। এটাই সেই পাথর যার কাছে হযরত সুলাইমান (আ) প্রসিদ্ধ ইবাদতগাহ হাইকালে  সুলাইমানী নির্মাণ করেছিলেন । এটাই সেই পাথর,যার উপর থেকে নবী করীম (সা) মেরাজের রা েএ আসমানে উঠেছিলেন।                                                             এ পাথরের উপর মসজিদ তৈরির উদ্দেশ্য হলৈ এটাকে রোদ -বৃষ্টি সহ বিভিন্ন ক্ষতিকর জিনিস থেকে হেফাযত করা ।সেজন্য এর উপর মজবুত ইমারত তৈরী করা হয়েছে।রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ                                          আমি মেরাজের রাতে বাইতুল মাকদিসে পাথররটির ডানে নামায পড়েছি।আরেকটি হাদিসে এসেছেঃবাইতুল মাকদিসের পাথরটির বেহেশতের পাথর।                                                                                                                         মসজিদে সাখরার ইমারতটি ৮কোণ বিশিষ্ট।এক কোণ থেকে আরেক কোণের দৈর্ঘ্য গড়ে ২০.৫৯মিটার।উওর থেকে দক্ষিণে প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য হচ্ছে যথাক্রমে ২০.৬৯,২০.৪২,২০.৭৪,২০.৬০,২০.৯৬,২০.৩৩,২০.৭৪ ও ২০.৭২ মিটার  এবং উচ্চতা হচ্ছে৯.৫মিটার ।প্রত্যেক দেয়ালের সাখরা  বা পাথর ।মেরাজে যাবার সময় রাসুলুল্লাহ(সা) এর ওপর বসেছিলেন।

Leave a Comment